• বদরুল ইসলাম বাদল

আজকের কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় অতীতে হলুদ রং এর ফুলে ভরা ছিল। ।আনাচে-কানাচে অরুপ রুপ ছড়াতো এই ফুল। সৌন্দর্য পিয়াসি প্রকৃতি প্রেমী মানুষ এই অঞ্চলকে তাই প্যানোয়া (হলুদ ফুল) এবং পালংকি নামে ডাকতো ।সুদীর্ঘ কাল থেকে এই পালংকির রুপে মোহিত হয়ে বহু রাজা, বাদশা, কবি, সাহিত্যিক সহ দেশী-বিদেশী ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের আসা-যাওয়া এখানে । কালের বিবর্তনে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন হীরামন কক্সের নামে কক্সবাজার নামকরণ হয় এই শহর।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমুদ্র সৈকতের জন্য ব্যাপক পরিচিত লাভ করে কক্সবাজার ।বিশ্বের সব চেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পরিচয় দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণ করে।তবে কক্সবাজারের অপরুপ সৌন্দর্যের উপর এখন শকুনির চোখ ।আর্থিক সুবিধা নিতে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যকে নষ্ট করছে লোভী কিছু মানুষ। মনুষ্য সৃষ্ট আগ্রাসনের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক মাধুর্যতা।তাই কক্সবাজারের প্রকৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা নিয়ে কক্সবাজারের সচেতন মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জেগে উঠেছে।তারা কক্সবাজারের নান্দনিক সৌন্দর্য রক্ষায় বদ্ধপরিকর। কক্সবাজারকে বাঁচানোর আকুতি নিয়ে মানব বন্ধন, সভা মিটিং হচ্ছে । জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দাবি আদায়ে চেষ্টা করছে।প্রশাসনের নীরবতা না ভাঙ্গলে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে বাধ্য করাতে শেষ পর্যায়ে হরতাল করার হুমকি দিয়ে রাখে আন্দোলনকারী সংগঠন সমূহ।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার। সাগর কন্যা,পর্যটন রানী সহ ভালবেসে মনের মাধুরি মিশিয়ে হরেক নামে ডাকা হয়। সমুদ্র প্রেমে ছুটে আসে প্রতি দিন হাজার হাজার পর্যটক। তাদের স্বাগত জানানোর কথা সমুদ্রের গর্জন,নীল জলরাশির ঢেউয়ের নাচের মুর্চনায়। ঝাউপাতার শনশন সুর আর গাঙচিলের ডানা দোলায়।তাতে পর্যটক মনে সৃষ্টি হবার কথা মুগ্ধতা, মোহনীয় আমেজ আর কবিমন গুনগুনিয়ে বলে উঠতো ,
“দক্ষিণা বাতাস ফিসফিসিয়ে ভালবাসা জানায়,
গাঙচিলেরা উড়ে বেড়ায় তোমার পাহারায়”। সাগর দর্শনে পর্যটক হারিয়ে যায় আপন ভুবনে।সৃষ্টির অকৃত্রিম সুধা পানে গেয়ে উঠে কবিতায়, “সাগর আমায় উদাস করে স্মৃতির পাতায় ডুব। নীল জলের গর্জনেতে মায়ায় পড়ি খুব”।

কিন্তু আজকাল সাগরে নামতে গিয়ে জলকেলির সুর শুনতে পাওয়া যায় না।পানিতে নেমে কান পেতে শুনতে হয়। বালুচরে গড়া দোকানের কোলাহল সাগরের আওয়াজকে নিস্প্রভ করে দেয়। ঝুপড়ি দোকান যেন দাড়িয়ে রয়েছে পর্যটক বরনে।আর স্বাগত করে , “কি নিবেন স্যার।কিছু লাগবে, আসুন দেখে যান”। চীন থাইল্যান্ড, মায়ানমার সহ অনেক দেশের বিভিন্ন ধরনের পন্য সামগ্রির দোকান পেরিয়ে সমুদ্রে নামতে বিরক্তিতে বিষিয়ে যায় ভ্রমণ পিপাসুদের মন।অনেক সময় হয়তো কেউ পথ আগলে বলে, “কিছু সাহায্য করেন স্যার,কিছু টাকা দেন”।আর ভাসমান হকারদের অতিরিক্ত পন্যসামগ্রি ক্রয়ের পীড়াপীড়ি নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আবেগ নিরেশ হয়ে যায় পর্যটক মন। এসব দেখে রাজশাহীর একজন পর্যটক কক্সবাজার সমুদ্র পাড়কে বানিজ্য মেলার সাথে মিলাতে চাইছেন।যাহা কক্সবাজার সৈকতের সুনামের উপর কুঠারাঘাত। লুটেরা কিছু মানুষের আগ্রাসী থাবায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার।লোভাতুর স্বার্থপর কিছু মানুষের কারণে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক খ্যাতি হারাচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এমন এক সময় আসবে কক্সবাজারের নামের সাথে আর লেখা যাবে না প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কিংবা নৈসর্গিক সৌন্দর্য রানি বা মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত ।তাই এখনই সময় চিহ্নিত সমস্যা গুলো সমাধানের ।ঝুপড়ি দোকান উচ্ছেদ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে।কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে গড়িমসি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। আদালতের রায়ের প্রতি প্রশাসনের অসহযোগিতা জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে নেতিবাচক মনোভাব। তাই প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ সময়ের দাবি।সবুজ পাহাড়, সাগর,নদীর এবং সমতল ভূমির মিলন মোহনা কক্সবাজার। কিন্তু অবাধে কাটা হচ্ছে পাহাড়, জবরদখলের কবলে বনভূমি। বীরদর্পে দখল করা হচ্ছে নদী। এখনো আশাবাদী কক্সবাজারবাসী, বন্ধ হবে পাহাড় কাটা, দখল মুক্ত হবে বাকঁখালী নদী সহ সকল নালা, খাল জলাশয়।

প্রকৃতি থেকে মানুষের অনেক শেখার আছে । জগতের সকল ক্ষেত্র এক একটি জ্ঞান অর্জনের পাঠশালা ।সৃষ্টির এই অপুর্বতায় দার্শনিকের উপলব্ধিতে উঠে আসে যে,”সমুদ্র যেমন কখনোই তার নিজের জল পান করে না,গাছ যেমন কখনোই তার নিজের ফল খায় না ঠিক সেইভাবেই জীবনে অন্যদের জন্যে ও বাচঁতে শেখা উচিত প্রত্যেক মানুষের। সমুদ্রের ঢেউ যেমন আসা যাওয়া করে, তেমনি কখনও কখনও পরিবর্তনের ঢেউয়ের মধ্যে আমরা আমাদের আসল দিশাকে খুঁজে পাই”।তাই এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের উপর আঘাত করে সমুদ্র সৈকতের লাবন্য নষ্ট করার কারণে হতাশ সচেতন মানুষ। কক্সবাজার পৌরসভার চার বারের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আবছার, বলেন, এই জনপদের সুন্দর পরিবেশের সাথে জড়িয়ে আছে শৈশব কৈশোর, বেড়ে উঠা।কক্সবাজারের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে নিজেদের ভাললাগা, ভালবাসা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে এই শহর ধ্বংস করতে দেয়া যায় না। প্রয়োজনে সরকারের শীর্ষ মহল পর্যন্ত অবহিত করা হবে প্রাণের শহর কক্সবাজারকে রক্ষা করার জন্য”।

কক্সবাজার জেলা সহ বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে অন্যতম বড় সমস্যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারে নাই। উপরন্তু বিশ্ব ব্যাংক সহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীকরণের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে।আর বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে এই বিষয়টি এখন তাদের চাকরি ও জীবিকার ধান্ধা। তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ নাই ।এই উপলব্ধিটি দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সবাই আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা সমস্যায় অতিষ্ঠ । তাই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে তাদের প্রত্যাবাসনের দাবি নিয়ে। জেলার বৃহত্তম তিন সামাজিক সংগঠন ,আমরা কক্সবাজারবাসী,নাগরিক ফোরাম এবং কক্সবাজার সোসাইটি যৌথ সভা করে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। সংগঠন সমূহ দ্রুত রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে সরকার, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অন্যান্য সংস্থাকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য জোরালো ভাবে তাগাদা দেয়। মায়ানমারের চরম অনিহা আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবহেলা এই সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু এসব সমস্যা জিইয়ে রেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবার নয়। তাই কক্সবাজারবাসী আগামী প্রজন্মের বাসযোগ্য আবাস ভূমির সমস্যা গুলোর দ্রুত সমাধান চায়।
জয় বাংলা।

—————————-
বদরুল ইসলাম বাদল
কলামিস্ট এবং সমাজকর্মী।
সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন,কেন্দ্রীয় কমিটি এবং
সাবেক ছাত্রনেতা।